অন্তত গত পনেরো দিন কোন স্বপ্ন দেখিনি, লিখতে পারিনি। চেষ্টা করেছি আশাব্যঞ্জক ধ্বনিদের খোঁজে কলমটাতে লাঙলের জোর দিতে, কিন্তু যে সবুজ জমিনে এখনও লাল দাগ, মায়ের কপোলে আর্দ্র অশ্রুরেখা, সেই জমিনের ভাইয়ের আর্তনাদ আর মৃত্যুর দ্বারে বসে থাকা আহতদের গোঙানি সব থামিয়ে দিয়েছে। দেশে বন্যা চলছে, শিল্পকারখানা মানুষ পুড়ছে, এই জল আগুনের নির্মম উত্তাপে খুব বেদনাকাতর মনে লিখতে হচ্ছে।
বানর থেকে এক বিবর্তনে আমরা যেমন মানুষ হয়েছিলাম, ঠিক তেমন দেশের রাজনীতিকে ম্লেচ্ছ জ্ঞান করা ব্রাহ্মণ আমরা যারা হঠাৎ রাজনৈতিক হয়ে উঠেছি, তারা ধরে নিয়েছিলাম এ জুলাই অভ্যুত্থান, এ বিপ্লব – রাজনীতির ইতিহাসে এক বিবর্তন এনে দেবে যা একাত্তরের পর হবে আরেক আলোকিত অধ্যায়। তবে বিপ্লব তো একটি সঞ্চিত চেতনা, হঠাৎ করে কেউ ডাক দিলো, আর চলে গেলাম সেরকম তো নয়। দীর্ঘদিনের নৈরাজ্যবাদ বঞ্চনা শোষণ, উৎপীড়ন, নিপীড়িনে অতিষ্ঠ নিরুপায় হয়ে ঈশ্বরকে যারা বিচার দিয়ে বসে ছিল, এ বিপ্লব ছিলো, তাদের কাছে জঘন্য পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের কবল থেকে বাঁচার একমাত্র ভেলা। তাই ক্ষমতাসীন দল ছাড়া বাংলাদেশের সকল জনগণের এই অভ্যুত্থানে সংযুক্তি ছিল নির্বিশেষে এবং দেশ গঠনের স্বপ্নে এমন এক পুরিয়া তারা গিলেছিল, যা বুলেটের সামনেও তাদেরকে আর থামতে দেয়নি।
যেহেতু অনেক দীর্ঘ লেখা, কিছু পয়েন্টে ভাগ করে আলোচনা করছি।
১। বিপ্লব পরবর্তী অবস্থাঃ
৫ই অগাস্ট মহা বিপ্লবের ক্ষণ, শেখ হাসিনার বিদায় হলো, চারদিকে নানান কেচ্ছাকাহিনী, বিদায়ী দলের ফিরিস্তি, হাজার মাথা পিছু ডলারের ঋণ, কেউ হয়ে উঠছে ইবলিশ, কেউ পয়গম্বর ফেরেশতা, এই চক্রাকার অমোঘ পূর্ণ দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ওয়ান ইলেভেনেও জাতিকে দেখতে হয়েছিল। ডক্টর ইউনুস যিনি পুরো পৃথিবীর সমস্যাকে মাত্র তিনটি শুন্য দিয়ে ব্যাখ্যা করতে জানেন, তিনি আমাদের অসীম আলো দেখিয়ে দেশের হাল ধরলেন। ইউনুস সাহেবের মতো নিরপেক্ষ লোক হাল ধরলেও, জনগণ স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে এই ঐতিহাসিক মুহুর্ততেও কি খুব আত্মপ্রসাদ লাভ করতে পেরেছে? ইতিহাসের পাতা উল্টালেই দেখা যেতো তার নাম, সেই শেখ মুজিব একদিনে হয়ে গেলো সবচেয়ে বড় স্বৈরাচারী। তার স্ট্যাচুতে মুত্র নির্গমন, বত্রিশ নম্বরে বুদ্ধিজীবির ছ্যার ছ্যার করে মল ত্যাগের আহবান, বিপক্ষ দলের চরমপন্থি মনোভব, তাদেরকে চেয়ার থেকে নামাতে দ্রুত তৎপরতা, ছাত্রদের লেলিয়ে দিয়ে শিক্ষককে জুতার মালা প্রদান, সারা দেশে ৬৬৬ শিক্ষককে জোর পুর্বক পদত্যাগ, মব জাস্টিস, গাজী কারখানায় ১৭৮ জন পুড়ে কয়লা- আর এই সমস্ত কিছুতে প্রশাসনের অদ্ভুত নিরবতা। কেউ কেউ আবার এটার ন্যায্যতা তুলছেন প্রতিবিপ্লবের মতো ভারী শব্দ এবং সুদীর্ঘকালের বঞ্চনা, সঞ্চিত ক্ষোভ, রাষ্ট্র সংস্কার সোজা কাজ নয়, সময়স্বাপেক্ষ এইসব শান্তনার বানী বলে।
২। ব্যর্থ উপদেষ্টা সকলঃ
রাষ্ট্র পরিচালনার ভার উপদেষ্টাদের হাতে। তারা রাষ্ট্রীয় ভবন যমুনায় রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ নিয়েছেন। তবে এই নানা অরাজকতায় উপদেষ্টাদের দৃশ্যমান পদক্ষেপ হিসেবে কি দেখতে পেয়েছি আমরা? মিটিং টেবিলে পানির জগ আর গ্লাস ছাড়া দৃশ্যত পদক্ষেপ হিসেবে আর কিছু দেখা যায়নি। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অরাজকাতা ও শিক্ষকদের হয়রানী নিয়ে প্রশ্ন করলে উপদেষ্টা আসিফ নজরুল নানা যুক্তি দিয়ে অপারগতা স্বীকার করে জানিয়েছেন, পুলিশ বাহিনীকে উনি সঠিক ভাবে ব্যবহার করতে পারছেন না। এখন প্রশ্ন হলো- যেহেতু একদল অন্যদলের উপর প্রতিহিংসার ঝাল মেটানোতে কিছু বিশেষ জনগণের সায় রয়েছে, তাই উপদেষ্টা পরিষদ থেকে বাদ পড়ার ভয়েই কি তারা মুখে কুলুপ এঁটেছেন, নাকি উপর থেকে আগত নতুন কোন স্বৈরাচারের আদেশের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন? আর সে যদি হয়েই থাকে দেশ কি তবে এখন ছাত্ররা চালাচ্ছে? আমরা সমন্বয়কদের দেখছি তারা দুদিন পরপর গণমাধ্যমে এসে নরম সুরে, স্তিমিত বাক্যে এই করবেন না, ঐ করবেন না অনুরোধ করছেন। সচিবালয় ঘেরাও হলে, সেই রক্ষাবুহ্যর ভারও ছাত্রদের নিতে হচ্ছে। বই খাতা ফেলে, তাদের কি আসলে দেশ পরিচালানোর কথা?
৩। এ আন্দোলন কাদের ছিল?
কোটা সরিয়ে সবাইকে ন্যায্য অধিকার, তারপর সেটি যখন গনহত্যা এবং গ্রেফতারে রুপ নিলো, রুমিন ফারহানা আন্দোলনে লাল শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে বলেছেন – এটা ছাত্রদের আন্দোলন এখানে আমাদের বলার কিছু নেই। দু’হাজারের বেশি প্রবাসীর অংশ গ্রহণে যে একটা মিটিং হয়েছিল সেখানে ছাত্র সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা ও একজন প্রবাসী বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক যে বক্তব্য দিয়েছিলেন সেই মিটিং এর বক্তব্যে সুস্পষ্ট- ছাত্ররাই শতভাগ এর দাবীদার, তাদের থেকেই এ আন্দোলন প্রসূত, অন্যরা তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। অপরপক্ষে বিগত সরকার দলীয়রা কিন্তু প্রথম থেকেই দাবী করেছিল- এটা কোটা আন্দোলন ছিল না, এখানে আমেরিকার হস্তক্ষেপ রয়েছে। গত কয়েকদিনের বিভিন্ন মাধ্যমে লেখালেখি থেকে থ্রিলার চলচ্চিত্রের রহস্য আবিস্কারের মতো, ছাত্র আন্দোলন থেকে এটি ক্রমশ হলো ছাত্র জনতার আন্দোলন,আর এখন যেন এটি একটি রাজনৈতিক আন্দোলন। আন্দোলনে যারা পিছন থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারা নিজেরাই নতুন তত্ত্ব, অনুসিদ্বান্ত আনছেন রোজ, বের হয়ে আসছে সব নতুন নতুন মহানায়কের ছবি। যেমন, আবদুল কাদের- সরকার কোটা আন্দোলনের একের পর এক দাবী মেনে নিলে নতুন কি দফা দিতে হবে, এগুলোর পরিকল্পনা করেছেন। আড়াল থেকে হঠাৎ বেরিয়ে আসা মাহফুজকে এই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড বলা হচ্ছে। প্রবাসী বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেছেন- “থানা কে আক্রমণ করেছে, কারা পুলিশকে মেরে ঝুলিয়েছে, এটা ছাত্ররা করেনি- আপনারাই বুঝে নেন”, তারপরই তিনি দাবী করেছেন এখানে রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ছিল এবং জানিয়েছেন যে ছেলেটি পল্টনে পুলিশের গুলির কাছে বুক পেতেছিল, সে বিএনপি কর্মী ছিল। এই আন্দোলনের যারা প্রবাসী নায়ক ছিলেন, তারা একে অপরকে ধন্যবাদ দিয়ে বলছেন, তাদের ১২ বছর এর প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। দৈনিক আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, ভিপি নুর সকলের বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে এটি পুর্বপরিকল্পিত ছিল। এবং মাহমুদুর রহমান বলেছেন, আগের চেষ্টাগুলো এগুলো সফল হয়নি, কারণ বিএনপি জামায়াতকে সুকৌশলে এড়িয়েছে আমেরিকার সমর্থন পেতে। আর এইসব থলের বেড়াল বেরিয়ে আসছে কারণ এখন যেন অনেকটা রেষারেষি চলছে এই আন্দোলনের স্টেকহোল্ডার কে কতটা এই নিয়ে? ছাত্রদেরকে বেশি নায়কোচিত কৃতিত্ব দিলে অন্য স্টেকহোল্ডাররা আবার এটি যেন সহজে মানতে পারছেন না, এবং কালের মহাগর্ভে নব্বইয়ের আন্দোলনের চার খলিফার মতই সহজেই নিশ্চিহ্ন হবেন এই সতর্কবার্তা দিচ্ছেন।
৪। এখন আমাদের সাধারণ নাগরিকদের কি চাওয়া?
ফ্যাসিবাদের পতন আমরা চেয়েছি, কারণ যখন একটিও নাগরিকের প্রাণ ঝরে, সেই নাগরিকের লাশের উপর দাঁড়িয়ে কোন সরকার তার শাসনকার্য চালাতে পারে না। কিন্তু সমসাময়িক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে খুবই বেদনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে কারো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতেই কি এতো রক্তক্ষয় হলো! ছাত্ররা তাহলে একটা আই ওয়াশ, এই কোটা আন্দোলন কি একটা অজুহাত! তবে বিপ্লব বিপ্লবই, একাত্তরের লড়াই নিঃসন্দেহে যদিও ছিলো আরো বেশি দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী ও ত্যাগ তিতীক্ষাপূর্ণ, তবে এই বিপ্লবকে কোন উদ্দেশ্য প্রণোদিত আন্দোলন বলে আমি এর মাহাত্ম্যকে ছোট করতে চাই না। এই বিপ্লবে অংশগ্রহণ করে দীর্ঘদিনের স্বৈরাচার পতন যখন হয়ে গেছে পথ যতো কণ্টকই আর ফাঁদ পাতা হোক,পথে যখন আমরা নেমে পড়েছি, দেশের স্বার্থে আমাদের আর পিছু ফেরার উপায় নেই। নতুন করে আর যেন কেউ স্বৈরাচারী ব্যবস্থা জারি করতে না পারে, সেই আমাদের চাওয়া।
৫। রাজনৈতিক অন্যদলগুলো কি ভাবছে?
বিএনপি প্রথমে বলেছিল,তারা এই নতুন সরকারকে সময় দেবে কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তাদের ধৈর্য রেখা খুবই সংক্ষিপ্ত। তারাই নানা মাধ্যমে এখন উপদেষ্টাদের ব্যর্থতা নিয়ে কথা বলছে, তাই এই অরাজকতার পিছনে কাদের ঠিক কতখানি হাত এবং দাবার শেষ চালের মতো নির্বাচনকে এগিয়ে আনার এটিও কোন তড়িৎ কৌশল কিনা এখনও বোধ্যগম্য নয়। আওয়ামী লীগ দুঃশাসন চালিয়েছে, তবে দুঃশাসন এই দেশে প্রথম নয়। এই দেশের স্বাধীনতার পরবর্তী ইতিহাস জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো’র মতো। এবং দেখা গেছে বিএনপিও তার শাসনামলে তার নানা কার্যবিধির জন্য জনসমর্থন হারিয়েছেন। কিন্তু আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিরা বলছেন- আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে,কারণ তারা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বপ্রদাণ কারী দল হলেও যেহেতু তারা এই জুলাইয়ে গনহত্যা চালিয়েছে, কিন্তু একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ করলেও জামায়াত ইসলাম থাকবে এই দেশে। জামায়াত ইসলাম এর ব্যপক প্রচার প্রসার জন সমর্থন গত কয়েক সপ্তাহে দেখা গেছে। হারাধনের দশটি ছেলের মতো ভিপি নূর বলেছেন আওয়ামী লীগকে বাদ দিলেও তো দেশে গণতন্ত্র থাকে কারণ দেশে ৬৪টা নিবন্ধিত দল রয়েছে! বিএনপির মির্জা ফখরুল সাহেবের বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে জামায়াতকে তারা বিচুটি পাতা হিসেবে গন্য করছেন এবং এই জামাত বিএনপি বিরোধী বিরোধী খেলা চলতে থাকলে আওয়ামী লীগের গত নির্বাচনের মতো আরেকটি ডামি নির্বাচন এর সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে প্রধান উপদেষ্টার সহকারী মাহফুজের তার বক্তৃতায় আওয়ামী লীগকে নিয়েই রাজনীতি করতে মতামত দিয়েছেন।
৬। রাষ্ট্র সংস্কার নীতির বিভ্রান্তিঃ
রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে ভাবতে বসলে- কেমন রাষ্ট্র চাই, এবং রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কি কৌশল ও নীতি নেওয়া উচিৎ এটিই সর্বাগ্রে মাথায় আসে। প্রথমেই যেটি করা উচিৎ, ধরে নিতে হবে এ বিপ্লবের বিজয় কোন গোষ্ঠীর নয়, এটি সকলের এবং বিপ্লবকে সফল করতে বিপক্ষদলের প্রতি প্রতিহিংসা পরিহার করতে হবে। না হলে বর্তমান অস্থিতিশীল অবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালনার গোদের উপর বিষ ফোঁড়া হয়ে দাঁড়াবে এ প্রতিহিংসা। আমাদের রাজনৈতিক দর্শন, ধর্ম সংস্কৃতি, ইতিহাস, জাতীয়তাবোধ এইসব ভেদাভেদকে অভেদ করে তুলতে পারে যে রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো, সেই মৈত্রীর ভিত্তিতেই রাজনৈতিক পরিগঠন অতি জরুরী।
ছাত্ররা নতুন দলগঠনে আগ্রহী নয়, আবার বাংলাদেশের বাম রাজনীতিও কখনই সুবিধা করতে পারেনি। আমাদের বর্তমান দলগুলোর আদর্শিক ও ধর্ম ভিত্তিক দ্বন্দ্ব এতো বেশি- যেখানে আত্মউন্নয়নকে মুখ্য না করে পরস্পরকে চিরাচরিত শত্রু গন্য করতে হবে- এই দর্শনেই তারা বিশ্বাসী। জনগণের কেউ কেউ মতামত দিচ্ছেন, ধর্মকে আমাদের গ্রাহ্য করতেই হবে রাজনীতিতে, তাকে না এনে উপায় নেই। তবে প্রগতিশীলদের ভয় তাতে জাতীয়তাবাদ দুষ্ট হয়ে পড়ে কিনা, হয়ত আধ্যাত্নিক প্রশান্তি হতে পারে কিন্তু জাতীয় মুক্তি কি হবে? তারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরোধিতা করছেন, ধর্মভিত্তিক দলগুলোর নানান দুষ্কর্ম অসুবিধা তুলে ধরছেন। অপরপদল দাবী করছেন- ধর্ম মানেই অপ্রগতিশীলতা- এই একপেশে চিন্তাচতনা এক ধরণের বর্নবাদীতাও বটে। দেশের বিরাট গোষ্ঠী মাদ্রাসা শিক্ষার সাথে জড়িত। তাই কেউ ইসলাম প্রচার করবেন নাকি শ্রীচৈতন্যের বানী প্রচার করবেন, সেই স্বাধীনতাও স্বাধীন দেশের নাগরিকের থাকার কথা? আমার ব্যক্তিগত অভিমতে যখন একটি রাজনৈতিক দলের মেরুদন্ড যখন ধর্ম হয়ে ওঠে, সেটা নাগরিককে শংকিত করে বটেই। কারণ কেমন হবে তার পুরুষতন্ত্রের গঠন, আধুনিকতার চর্চা, নারীর ক্ষমতায়ন। নারীর পোশাকনীতি,পরাধীন নারীর বাংলাদেশ কি খুব চমৎকার হবে? তাই আমাদের জনগণের উচিৎ হবে অন্য দেশের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা- কিভাবে শ্রীলংকার বিপ্লব অকেজো হয়েছে। পাকিস্তান আফগানিস্তান ধর্মকে পুঁজি করে ধুঁকছে। এগুলো পর্যালোচনা করেই দলগুলোর পরিশুদ্ধি ও নীতি নির্ধারণ করা উচিৎ যাতে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতার খড়্গহস্ত যেন এ জাতির কাঁধে চেপে না বসে।
৭। মব প্রতিক্রিয়া ও ফেসবুকের হাওয়াঃ
দেশ যেন এখন পড়েছে কতিপয় দুর্জন বুদ্ধিজীবির হাতে! একটা রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শত্রু তার সেইসব শিক্ষিত জনগোষ্ঠী যারা বুঝে শুনে অন্যায়কে ন্যায় প্রমাণে স্নায়ুযুদ্ধ ঘোষনা করে, তখন বাকী জনগোষ্ঠীও তাদেরকে সমর্থন করে, চোখ বুঝে অন্যায় ন্যায় বলে মেনে নেয়। শেখ মুজিব একাত্তরে পালিয়ে গেছেন, এসব বক্তৃতায় হাজার হাজার তালি পড়ছে। তরুনদেরকে স্বাধীনতার ইতিহাস জানতে মতিউর রহমান রেন্টু ও মেজর ডালিমের বই পড়তে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে এটা খুব পরিস্কার যে এই জুলাই অভ্যুত্থানের কৃতিত্ব একদল অনেকটাই নিজেদের দাবী করেছে এবং আপনারা বুঝতে শুরু করেছেন, এরা বেশ শক্তিশালী, আপনি এদের বিরুদ্ধে কথা বললেই হেনস্থার শিকার হবেন। কিন্তু এই আচরণ চলতে থাকলে এক ফ্যসিবাদ থেকে আরেক ফ্যাসিবাদ ডেকে আনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করছি আমরা নিজেই। এখন বিএনপির বিরুদ্ধে কথা বললেই- কারো স্কলারশীপ বাতিলের জন্য আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যন্ত যোগাযোগ করা হচ্ছে, তাকে প্রায় বিবস্ত্র করার মতো মানহানি করছে সব অনলাইনযোদ্ধারা। দু’দিন পর কেউ কেউ একটা নতুন ইতিহাস লিখছে আর তরুণদের সহজেই রুপান্তরিত মন সেটাকে হৈ হৈ করে হ্যাঁ বলছে কারণ অমুক জনৈক বুদ্ধিজীবীর লালারসে ভেজা বাক্য এটি। মস্তিষ্ক শীতল করে নিজেদের বিবেক বুদ্ধি দিয়ে ভাবার লোক অথবা সাহসী লোকের এই মুহুর্তে খুব খরা চলছে এই বন্যাকবলিত দেশে। যেহেতু গণতন্ত্র চাচ্ছি আমরা, তাই প্রতিটি দলের চুলচেরা বিশ্লেষণের অধিকার জনগণ রাখে। জনগণের কাছে জবাদিহিতা করার দ্বায় এড়িয়ে গেলে রাজনৈতিক পরিশুদ্ধি, রাষ্ট্র সংস্কার অন্তত আগামী একশো বছরেও দেশে অধরা স্বপ্নই রয়ে যাবে।
শেষ কথা, সবচেয়ে পীড়ার যেটি বিষয়, যে তরুন সম্ভাবনাময় ছেলেগুলো জীবন দিলো, মুগ্ধ, ফায়াজ, আহনাফ, আরও কতো শত নাম- তারা কেউ পিছনের এ রাজনৈতিক খেলাটা জানতো না। একটা নতুন দেশের স্বপ্নে প্রবাসীরা পর্যন্ত এতো বিভোর ছিল, এই আন্দোলনে তারা ঘামের অর্থ যোগান দিয়েছে, নিজের ব্যক্তিগত জীবন চাকরী সব চুলোয় দিয়ে সময় দিয়েছে। স্বপ্নের নেশা কতো প্রবল হলে এতো আরাম আয়েশ ছেড়ে কতোজন প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে দেশে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছে। আমাদের ছেলেরা শিক্ষক লাঞ্ছিত করতে, মব জাস্টিস হতে এই রক্ত দেয়নি। ন্যায় অন্যায় এর নিজস্ব ব্যখ্যা প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে দস্তয়েভস্কি কাইম এন্ড পানিশমেন্ট এর নায়ক রাস্কোলনিকভের মতো অনুশোচনা ও পরিনতি আমাদের যেন না হয়। শহীদের রক্তের প্রতিটি ফোঁটার, প্রতিটি হারিয়ে যাওয়া জীবনের মর্যাদা দিতে হলে এখনই অন্ধ অনুকরণ, দল দ্বাসত্ব ত্যাগ করতে হবে। তাই সময় এসেছে এখন পাকিস্থানপন্থী, ভারতপন্থী, আমেরিকাপন্থী, সোভিয়েতপন্থী রেষারেষি ভুলে শুধু বাংলাদেশপন্থী হতে হবে এবার।